অধিকার মানুষের জন্মগত। সমাজের প্রতিটি মানুষ অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিবেচনায় সব মানুষের অবস্থান রাষ্ট্রে সমান নয়। চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নিম্ন আদালতে কর্মরত কর্মচারীদের অবস্থান অতি নিল্ফেম্ন। দেশের নাগরিক হিসেবে সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নিম্ন আদালতে কর্মরত কর্মচারীদের ভূমিকা অনন্য।
তাছাড়া, দেশের যেকোন প্রান্তিক অবস্থানে বিচার বিভাগের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। গত ১৯ এপ্রিল ২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘১০ বছরের পুরাতন মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ’ শিরোনামে একটি খরব প্রচারিত হয়।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার জট হ্রাস ও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার তথা দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিম্ন আদালতের প্রত্যেকটা কর্মচারী এই দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণের সাথে জড়িত। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তয়নের লক্ষ্যে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের অধিকার নিশ্চিত করণের স্বার্থে প্রতিনিয়ত পরোক্ষভাবে কাজ করছে নিম্ন আদালতের প্রায় ২০ হাজার কর্মচারী। তবুও তাদের ভাগ্যের চাকা অপরিবর্তিতই থেকে যায়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর গত বছর বাংলাদেশ বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে। মুজিববর্ষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে গোটা জাতি। ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল বর্তমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বহুমুখী স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। একমাত্র লক্ষ্য দেশের সব নাগরিককে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সম্পৃক্ত করা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান একজন নিম্ন আদালতের গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মচারী ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীতেও উক্ত পদের কোন পরিবর্তন করতে পারি নাই।
কবির ভাষায়–
“সময়ের কাজ অসময়ে করি
অকারনেই ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলি;
কাজের গুনগত মান অবজ্ঞা করি
অহেতুক জীবনকে চ্যালেঞ্জে ফেলি ।”
নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার নথিতে দেশের প্রত্যেকটি আদালত পরিপূর্ণ। বিচারিক নথি সংরক্ষণ করার মতো তুলনামূলক কম আসবাবপত্র সরবরাহ করায় নথির রক্ষণাবেক্ষণ করা কষ্টসাধ্য। আর সেই নথি পূর্ণ কক্ষে মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করে নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা। ভার্চুয়াল জগতে নথির ভারে প্রায় গতিহীন বিচার ব্যবস্থা সচল করতে আদালতের রায় প্রস্তুতকরণের সহায়ক কর্মচারী স্টেনোগ্রাফার এর অবস্থা প্রায় বেহাল। যেখানে প্রত্যেকটি আদালতে বিচারিক অবস্থা নিরুপণ করার জন্যে মামলার নিষ্পত্তিই মূল মাপকাঠি, সেখানে মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তাকারী একটি ব্লক পদে কর্মরত নিম্ন বেতন গ্রেডভুক্ত কর্মচারী।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আদালতের নথির রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং মামলার প্রারম্ভিক পর্যায়ে নির্ধারিত কোর্ট ফি নিরীক্ষাকারী এবং শপথনামা কমিশনার হিসেবে জুডিসিয়াল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী এবং বিচারাধীন মামলার পরিসংখ্যানকারী আদালতের সর্বোচ্চ পদে কর্মরত একজন উচ্চমান সহকারী (সেরেস্তাদার) জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ অনুযায়ী বৈষম্যপূর্ণ গ্রেডের বেতনভুক্ত কর্মচারী। জেলা জজ ও অধঃস্তন আদালত সমূহ এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত সমূহ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯ এ আদালতের প্রত্যেকটি পদে পদোন্নতির সুযোগ রেখে নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ণ করা হলেও মন্ত্রণালয়ের ন্যায় পদ ও পদবি পরিবর্তন হচ্ছে না।
ইহাছাড়া, দেওয়ানি আদালতে বাদী ও বিবাদীদের মামলা সম্পর্কে অবহিতকরণের সমন সঠিকভাবে জারী না হলেই একটি মামলায় আরও কয়েকটি মামলার জন্ম দেয় এবং মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা জন্মায়। সমন সঠিকভাবে জারী করা এবং দেওয়ানি ডিক্রিজারী মামলায় আদালতের নির্দেশে বিরোধীয় ভূমির দখল হস্তান্তরের এই জুডিসিয়াল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী আদালতের গুরুত্বপূর্ণপদে কর্মরত একজন নাজির।
উপরোক্ত পদ ও পদবি অনুযায়ী নিম্ন আদালতের সহায়ক কর্মচারীরা যে যার অবস্থান থেকে মামলার নিষ্পত্তিতে প্রতিনিয়ত জুডিসিয়াল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সত্ত্বেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তারা জুডিসিয়াল পে স্কেল অন্তর্ভুক্ত নহে। বলা হয়ে থাকে, বিচার বিভাগীয় কর্মচারী। কিন্তু এই সহায়ক কর্মচারীদের পরিচয় আদৌ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নহে। যেখানে বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত অন্যান্য পে স্কেলে বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়, সেখানে একমাত্র বিভাগ যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আলাদা পরিচয় থাকা সত্ত্বেও সহায়ক কর্মচারীদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কর্মকর্তাদের অন্তর্ভূক্ত করে পে স্কেল প্রদান করা হয়। সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে নিম্ন আদালতের কর্মচারীরাও সমান দাবিদার। বৈষম্যের শিকার নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বিচার বিভাগের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের সুষ্ঠু বাস্তয়ন করতে অবশ্যই এই সহায়ক কর্মচারীদের কথা একটু আলাদা করে ভাবতেই হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি পর্যায়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও অন্যান্য বেসামরিক অফিস সমূহে কর্মরত কর্মচারীদের ভাগ্য উন্নয়নে সকলের সু-দৃষ্টি থাকলেও নিম্ন আদালতে কর্মরত কর্মচারীরা আজ নিরুপায়। দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতিতে চিড়েচ্যাপ্টা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার। পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুরবস্থার কথা নিয়ে লেখা হচ্ছে। বুকফাপা কষ্ট নিয়ে দিনের পর দিন জীবিকার তাগিদে আদালতে দিন থেকে রাত পর্যন্ত দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা। পারিবারিক ব্যয়ে বেপরোয়া প্রায় নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে, নিম্ন আদালতের কর্মচারীদের পদ ও পদবি পরিবর্তন করতঃ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী গণ্যে নবম জাতীয় জুডিসিয়াল পে স্কেল প্রদান নিম্ন আদালতে কর্মরত প্রায় বিশ হাজার কর্মচারীর প্রাণের দাবী।
মো. আমান উল্লাহ, স্টেনোগ্রাফার, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত, বরগুনা।