কাজী নজরুল ইসলাম : বাঙালীর যে প্রতিভা বিশ্বের সকল সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণা
কাজী নজরুল তার “কুলি মজুর ” কবিতায় বলেছেন,
“তুমি শুয়ে রবে তে’তলার উপরে –
আমরা রহিবো নিচে ‘
অথচ তোমারে দেবতা বলিবো,
সে ভরসা আজ মিছে। ”
কতটা প্রতিভাবান হলে মাত্র ৪ লাইনের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা, মহত্মা গান্ধী, চে গুয়েভারা, মাও সে তুং,কার্ল মার্ক্স সহ সকল বিল্পবীর সারাজীবনের সকল সংগ্রামের সারবস্তুকে লিপিবদ্ধ করা যায়। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বুদ্ধিনির্ভর কবি নন; স্বভাবকবি, হৃদয়নির্ভর রোমান্টিক কবি।
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য; আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।”
মাত্র দুই লাইনে তিনি যুদ্ধ, শক্তিমত্তা, নিজের বিধ্বংসী মনোভব, প্রিয়ার বিরহ উল্লেখ করেছেন।
মৌলিকভাবে কবি মূলত দুই প্রকার। মৌলিক ও ক্লাসিক।
ক্লাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমকে সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা কঠিন বিষয়।দার্শনিক ক্রোচে উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বলেন, “A great poet is both both classic and Romantic.”
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় নজরুল একই সাথে দুর্দান্তভাবে রোমান্টিক ও ক্লাসিক।আর এ দুটি মিলেই তৈরি হয় বিদ্রোহী মনোভাব। এটা ইচ্ছে করলেই হয়ে ওঠা সম্ভব না। যেমন তিনি তার কবিতায় বলেন,
” ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে-
ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’”
তখন আমরা বলি এটা তো প্রেমের প্রকাশ কিন্ত নজরুল আমাদের এটা দিয়ে অন্য একটি বার্তা দিচ্ছেন। এটিই কবির স্বকীয়তা।
আবার তিনি অসহায় মানুষের জন্য বলেন,
‘যুগ যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।’
কেউ প্রেমিক হয়ে কবি, কেউ কবি হয়ে প্রেমিক হয়। দুটিই বিপজ্জনক, এ দুটির কোনটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত টিকে আছে শুধু জাত কবিরা।
নজরুল আমাদের জাত কবি। নজরুলের প্রতিভা পরিমাপের জন্য শুধু ( বিদ্রোহী) কবিতার উপমাগুলোই যথেষ্ট।
* আমি কভু প্রশান্ত
* আমি ষোড়শীর হৃদি- সরসিজ প্রেম উদ্দাম
* আমি গোপন মেয়ের ভালবাসা, তার কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্!
* আমি পথিক কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া
* আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর।
* চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুলকে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলেন সমগ্র বাঙালির পক্ষে অ্যালবার্ট হলে (এখনকার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস ঘর) বাংলার বিশিষ্ট নাগরিকেরা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন জলধর সেন, সুভাষচন্দ্র বসু, অপূর্বকুমার চন্দ, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, এস ওয়াজেদ আলী, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রভৃতি। সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁর ভাষণে তিনি বলেন, “নজরুল কবি, প্রতিভাবান মৌলিক কবি।… আজ এই ভেবে বিপুল আনন্দ অনুভব করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি।”
এর প্রত্যুত্তরে নজরুল খুব সুন্দর করে বলেন, “আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।”
নজরুলের এই কথা সত্ত্বেও কোনও এক গোষ্ঠী তাঁকে যে ‘কাফের কাজীও’ বলে বিশেষিত করে এবং আরেক গোষ্ঠী তাঁকে “পা’ত (পাতি) নেড়ে” বলে গালাগাল দেয়।
নজরুল প্রভুর কাছে উজাড় করে চাইতে দ্বিধাবোধ করেন নি। তিনি বলেন,
“আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে বাঁচাও
প্রভু উদার –
হে প্রভু শেখাও-
নীচতার চেয়ে বড় পাপ আর নাই।
ক্ষুদ্র করো না -হে প্রভু
হ্রদয় আমার,
যেন এখানে ঠাঁই পায় –
শত্রু,মিত্র, পর। ”
একজন মানুষ উদার না হলে মহান প্রভুর কাছে এই ফরিয়াদ করতে পারে না।
একজন সৃজনশীল ব্যক্তির প্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করে। এক, তার সৃষ্টির সৌন্দর্য ও তাতে জীবনের নান্দনিক প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন এবং সেসবের স্থায়িত্ব; দুই, ব্যক্তি হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা। নজরুল যুগপৎভাবে দুটিরই অধিকারী।
১৯৩০ সালে নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের (অরিন্দম খালেদ) মৃত্যু হয়। পুত্রশোক এত প্রবল হয়েছিলো যে নজরুল পরে গভীরভাবে আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে ঝোঁকেন এবং দীক্ষা নেন। উল্লেখ্য, এই শিশুর রোগশয্যার পাশে বসেই মহাকবি হাফিজের মূল ফারসি থেকে রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ বাংলায় অনুবাদ করেন এবং এই কাব্য বুলবুলের নামে উৎসর্গ করেন।
নজরুল ছিলেন সাধারণ আমজনতার একজন। তিনি উঁচুতলার বাসিন্দা ছিলেন না কোনোদিনও। কৃষক-জেলে-মজুর-শ্রমিক-তাঁতী-জোলা-নাপিত-কামার-কুমার-ফেরিওয়ালা-মাঝি–এই গণমানুষের মাঝে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাদের সুখ-দুঃখ ও আবেগ-অনুভূতি তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সেজন্যই নজরুলের কবিতা-গানে তাঁদের মুক্তির দিশা রয়েছে। তিনি গণমানুষের কবি, তিনি সম্মিলিত মানবজাতির বলিষ্ঠ কণ্ঠধর। তাঁর কিছু কবিতার চরণ স্মরণ করা যায়:
. নারী পুরুষের সমতা ও নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত কবি
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
পৃথিবীর বুক থেকে অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন চিরতরে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করেছেন।
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না,
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
নজরুল তাঁর শেষ অভিভাষণে কবি হিসেবে তার চাওয়া-পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন:
‘হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব—, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে—এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবেন অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম—অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম—আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম-সুন্দর।’
তিনি ধর্মব্যাবসায়ীদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ :
“তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’
কোথা চেঙ্গিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!”
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক গান বা কবিতার কারণে সবসময় তিনি ছিলেন ধর্মান্ধদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়েছেন তার সৃষ্টিতে দেব-দেবীদের আরাধনা দেখে, আবার সনাতনীরা খেপেছেন যখন তিনি বলেছেন “আমি বিদ্রোহী ভৃত্য, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।”
এই নজরুলই আবার কালীকে নিয়ে শ্যামাসংগীত লিখেছেন: “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। (তার) রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন।”
আবার রসুলকে নিয়ে নাত: “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে। মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে। যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।”
নজরুল তার সারাজীবনে কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, করেছেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তিনি সারাজীবন চেষ্টা করেছেন ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার আর তার কারণেই মানবধর্মের উপর তিনি বারবার জোড় দিয়েছেন, বলেছেন শোষণহীন সমাজের কথা। তার মতো করে এতো সুন্দর করে এতোটা সাহস করে আর কে কবে বলেছে:
“মোরা এক বৃত্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।”
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, “প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন ক্ষয়ে যেতে হয়। ”
নজরুল আমাদের নক্ষত্র ছিলেন। তিনি আজ নেই।
১৯৪২ সালে বাকশক্তি হারান নজরুল। মাত্র ২২ বছরের লেখক জীবনে লেখেন প্রায় ৩ হাজার গান, অসংখ্য কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস।
১৯৭২ সালে কবি নজরুলকে সপরিবারে নিয়ে আসা হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন কবি। তার ইচ্ছানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
নজরুলই নিজেই বলেছিলেন,
“যেদিন আমি হারিয়ে যাবো,
বুঝবে সেদিন বুঝবে-
অস্ত পারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।
বুঝবে সেদিন বুঝবে। ”
প্রিয় কবি আজ এই দুঃসময়ে আপনাকে দরকার। আমরা আপনার শূণ্যতা অনুভব করছি ।
১৯৬৯ সালের Midnight Cowboy মুভির একটি উক্তি ছিল
. “I’m walking here! I’m walking here!”
যখন দেখি কেউ মানুষের পক্ষে কথা বলে, গরীবের জন্য কাঁদে, শোষণের প্রতিবাদ করে মনে হয় প্রিয় নজরুল আপনি আছেন আমাদের পাশে আর বলছেন,
“I’m walking here”
শুভ জন্মদিন কবি, শুভ জন্মদিন বাঙালীর নক্ষত্র
তথ্যসূত্র :
গোলাম মুর্শিদ
মুহাম্মদ আল মাসুম মোল্লা
কমরুদ্দিন আহমেদ
©Faijul Islam Fahim
সহযোগী সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ