বৈশ্বিক অস্থিরতা ছাড়াও নানা অজুহাতের ঘোড়ায় চেপে রীতিমতো ঊর্ধ্বমুখে ছুটছে জিনিসপত্রের দাম। লাগাম ছাড়া সেই ‘পাগলা ঘোড়ার’ দাপটে সাধারণ মানুষের যেন চোখে সরষেফুল দেখার মতো অবস্থা। জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতো সংসার চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। কারণ, দাম বাড়েনি- এমন পণ্যই বাজারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার এই সময়ে শুধু নিম্নবিত্তরাই নয়, সংকটে আছেন মধ্যবিত্তরাও। কারও উপার্জন কিংবা পকেটের আয় বাড়েনি। সে যাই হোক, হু হু করে ঠিকই প্রতিদিন বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম!
কঠিন এই মুহূর্তের মধ্যেই দু’দিন আগে বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। আর এই মূল্যবৃদ্ধি যেন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। কী করবেন- ভেবেই পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। হাজারো অংক কষে সংসার চালানোর উপায় খুঁজছেন সবাই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষসহ সমাজের সবার ওপরই এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত জুনে দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে। যা বিগত আট বছরে সর্বোচ্চ। এ কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সেই সঙ্গে মজুরি সূচক ও মূল্যস্ফীতি প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে আয়ের তুলনায় নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান চড়া দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়ে ভোক্তারা এখন নিজেদের ব্যয় কমাচ্ছে।
সরকারি হিসেবেও প্রায় অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। খোদ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলেছে- গত বছরের ১ আগস্ট থেকে চলতি বছরের একই তারিখ পর্যন্ত এক বছরে নিত্যব্যবহার্য গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি পণ্যের দাম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, আলু, গুঁড়া দুধ, গরুর গোশত, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, চিনি, শুকনা মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, জিরা ইত্যাদির দাম কয়েকগুণ বেড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দামামায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আটা-ময়দার ওপরে। এক বছরে ৪৪ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়ে প্যাকেটজাত আটার বর্তমান দাম ৫০ টাকায় উঠেছে। একই অবস্থা ময়দার ক্ষেত্রে। গত বছরের ৪৫ টাকা কেজি ময়দা প্রায় ৫২ শতাংশ বেড়ে বর্তমান মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬২২ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত।
বাজারের সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে ভোজ্যতেল। বৈশ্বিক অস্থিরতার পাশাপাশি অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে দফায় দফায় বাড়ছে দাম। বোতলজাত এক লিটার তেল ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমান দাম হয়েছে ১৮৮ টাকা। এরপরও পাওয়া যাচ্ছে না নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি। এছাড়া ৮০ টাকা কেজি মসুর ডাল এক বছরে ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেড়ে ১০০-১১০ টাকা ও আলু ২৫ টাকা থেকে প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে। পাশাপাশি ২০ শতাংশ বেড়ে জিরার দাম ৪৪০ টাকা, গুঁড়া দুধ ২২ শতাংশ বেড়ে ৭২০ টাকা, ডিম ৩০ টাকা থেকে ৩০ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে ৪২ টাকা, চিনি প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে ৮২ টাকা, শুকনা মরিচ প্রায় ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৩২০ টাকা, হলুদ ২৬০ টাকা, ধনিয়া ১৬০ টাকা, গরুর গোশত ৬৮০-৭০০ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগি ১৫৫ টাকা হয়েছে।
এদিকে, গত শুক্রবার (৫ আগস্ট) জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিআরটিএ’র মাধ্যমে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে গণপরিবহনের মালিকরা। ফলে নয় মাসের মধ্যে ভাড়া বাড়ার হার দাঁড়িয়েছে ১৭ থেকে ২২ শতাংশ।
অন্যদিকে বাজারেও পড়তে শুরু করেছে বিরূপ প্রভাব। তেলের দাম বাড়ার পর কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ সবজিরই পাইকারি দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। খুচরা বাজারে যা ঠেকছে ১০ থেকে ২০ টাকায়। এতে সাধারণ ক্রেতারাও বলছেন, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় জীবিকা নির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। বাসা থেকে হিসাব করে টাকা এনে বাজারে এলে তার আর ঠিক থাকে না।
সাধারণ মানুষের ভাষ্য, নানা বাহানায় একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে, গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ছে গণপরিবহন, দ্রব্যমূল্যসহ বহুমুখী ক্ষেত্রে। কিন্তু বাড়ছে না আয়ের উৎস। সবমিলে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।
এতে বাড়তি দামের বোঝা সামাল দিতে কাটছাঁট হচ্ছে পুষ্টির তালিকা। তাইতো বাচ্চার জন্য দুধ, ডিম বা ফল কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী তমাল হাসান। নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের চাপ সামলাতে দৈনন্দিন খরচের বাজেট কমিয়ে এনেছেন তিনি। আর কোথাও খরচ কমানোর উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে জুলাই মাসে সবজি কেনাও কমিয়েছেন।
তমাল জানান, স্ত্রী ও সন্তানসহ তিন সদস্যের পরিবারের জন্য সবজি ও সাবান ছাড়াও টুথপেস্ট এবং ডিটারজেন্ট পাউডারের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মাসিক বাজেট আট হাজার টাকা। কিন্তু গত মাসে তাদের এসব নিত্যপণ্য কেনার জন্য বাকি ছিল মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা।
যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে।
তবে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল স্মরণ করিয়ে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হবে।
এদিকে, তেলের দাম বাড়ার ফলে কৃষিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না- এমন প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এ দেশের কৃষকরা পরিশ্রমী, তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। হয়তো কৃষকদের একটু লাভ কম হবে।
মন্ত্রী আরও বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে শাকসবজি ও ফল রফতানি করতে যাচ্ছি আমরা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটা স্বাভাবিক বিষয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে আবারও পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
সার্বিক বিষয়ে কথা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে যে দাম বাড়িয়েছে, তা একবারে অন্যায় ও অযৌক্তিক। তেলের দাম বাড়ায় ব্যাপক হারে সমাজে এর প্রভাব পড়বে। এক ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হবে। হুমকির মুখে পড়বে মানুষের জীবনযাত্রা।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানি হওয়ার কথা থাকলেও তার কোনো বালাই নেই। সরকারের মেগা প্রকল্পের বড় বড় দুর্নীতি ঢাকতেই তেলের দাম বাড়িয়ে তা আড়াল করা হচ্ছে।’