দ্যা পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশেন : এই সুন্দর শ্রীলঙ্কার হঠাৎ কি হল?
১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট পার করছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানিরও ক্ষমতা হারিয়েছে দেশটি। মারাত্মক অর্থনৈতিক ও জ্বালানিসংকট তৈরি হয়েছে। হাজারো মানুষ ফিলিং স্টেশনের সামনে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। মুদ্রা বিনিময় সংকটের কারণে আমদানি বিধিনিষেধ থাকায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে।
জ্বালানী তেলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে দেশটিতে। তেল সংগ্রহের জন্য হাজার-হাজার মানুষ লাইনে ভিড় করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে দেশটির সরকার।
কারণ, জ্বালানী তেল আমদানি করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নেই শ্রীলংকার কাছে।
ইরানের কাছ থেকে জ্বালানী তেল আমদানি বাবদ আড়াইশ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি শ্রীলংকা। এর বিনিময়ে প্রতিমাসে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চা ইরানে রপ্তানি করবে শ্রীলংকা। এভাবে ধীরে ধীরে সে টাকা পরিশোধ করা হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে শ্রীলঙ্কার দেউলিয়াত্বের কারণ
বিভিন্ন খাতে অপরিণামদর্শী বৈদেশিক ঋণ
শ্রীলংকা একযুগের বেশি সময় ধরে তাদের দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা ধরণের প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় ও অতিবাহুল্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদারছে ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। যার কারণে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে খালি হতে থাকে। সেদেশের অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে।
কৃষিখাতে অপরিকল্পিত অর্গানিক ফার্মিং
রাতারাতি কৃষিখাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের একটি হঠকারি ও অবিবেচক (তোগলকি) সিদ্ধান্ত। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া দেশের কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের কারো সাথে শলা-পরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণেও দাবি করেন যে বিশ্ব থেকে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহারকে নির্মূল করতে নেতৃত্ব দেবে শ্রীলংকা। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি অনুসরণে কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে বিশ্বে ‘পাইওনিয়ার’ হবে শ্রীলংকা। তাঁর সরকার জৈব কম্পোস্ট সার সরবরাহের প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে, যাতে রাসায়নিক সারের ‘প্রকৃতি-বান্ধব বিকল্প’ ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা যায়। কিন্তু, মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া–এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! কৃষক ‘অর্গানিক ফার্মিং’ করার প্রয়োজনে জৈব কম্পোস্ট সারের জন্য হাপিত্যেশ করলেও পুরো ফলন-মৌসুমে তার দেখা মেলেনি। ফলে, এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলংকার কৃষিখাত। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শ্রীলংকার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে আসলো এক-চতুর্থাংশে।
পর্যটন খাতে ধ্বস
শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য এর চিরায়ত এক প্রতিচ্ছবি। মহামারী করো শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। করোনা সতর্ক শ্রীলংকার তেমন কোন ক্ষতি না করলেও বন্ধ করে দিয়েছে পর্যটন শিল্প।
গত দু’বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এহেন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলংকার রফতানি আয়ের আরো দুটো প্রধান সূত্র এলাচ এবং দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দু’বছরে।করোনায় ভয়াবহ সংকটে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত। দেশটির জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে
কর কমানো
দুই হাজার উনিশ সালের নভেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হবার পরে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট দেশটিতে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ ধরণের পদক্ষেপে অনেক বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আট শতাংশে আনা হয়।
ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর মূল কারণ ছিল অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা।কিন্ত এর ফলাফল হয় উলটো।
রাজাপাকসে পরিবারের পারিবারিক একনায়কতন্ত্র
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপাকসে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।তেমনি দেশের প্রতিটি খাতে এই পরিবারের হস্তক্ষেপের পরিণতি আজকের দেউলিয়াত্ব।ক্ষমতায় আসীন হয়ে এবার বড়ভাই মাহিন্দা ছোটভাই গোটাবায়াকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী বনে গেলেন। গৃহযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর সিংহলী জাতিসত্তার যে উগ্র-আধিপত্য স্থাপনের খায়েশ বাস্তবরূপ পেয়েছিল সেটাই রাজাপাকসে পরিবারের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ায় শ্রীলংকার গণতন্ত্রের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে এনেছে মনে হয়।
চীনের দাদাগিরি ও চীনকে বন্ধুরাষ্ট্রে রূপান্তর
বর্তমান পূজিবাদী অর্থব্যবস্থায় কোন দেশ কারো বন্ধু হতে পারে না। শতকরা ১০০ ভাগ শিক্ষিতদের এই দেশ শ্রীলঙ্কা কেন এটা বুঝলো না সেটা বোধগম্য নয়।
২০১৩ সালে চীনের উদ্যোগে হাম্বানতোতায় গভীর সমুদ্রবন্দরে বিমানবন্দর স্থাপন এবং সেই বিমানবন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের তত্বাবধানে থাকবে৷ এর চেয়ে বড় হঠকারিতা আর কি হতে পারে?
এরপর অনেক দেশি বিদেশি অপরিণামদর্শী চুক্তি শ্রীলংকাকে এই অবস্থায় ফেলে দেয়।
রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে।
এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার।
এখন এই পরিস্থিতি থেকে শ্রীলঙ্কা কিভাবে উত্তোরণ পেতে পারে এটিই দেখার বিষয়। বন্ধুরাষ্ট্র হিশেবে আমরা শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি উত্তোরণের জন্য সার্বিক কল্যাণ কামনা করি।
তথ্যসূত্র : বিজনেস ইনসাইডার, দ্যা হিন্দু ও দ্যা বিজনেস টাইমসের অনুকরণে লেখা