ঘুস ,দূর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত ও তদন্তে বিভাগীয় মামলার সুপারিশকৃত অভিযুক্ত বরগুনা সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী কাম হিশাব রক্ষক দুলাল কৃষ্ণ মালাকার ওরফে দুলাল বাবুকে বিদায়ী সংবর্ধনা দিয়েছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। দুলাল বাবুকে সংবর্ধনা দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে এভাবে সংবর্ধনা দেওয়ায় নিজেদের চাকরি নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। তবে এবিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হয়নি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বরগুনা কার্যালয়ের কোন কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় গত ১৮ জানুয়ারি বুধবার বরগুনা সদর উপজেলার প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে মাসিক সমন্বয় সভায় ‘প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার, বরগুনা সদর’ এর ব্যনারে দুলাল কৃষ্ম মালাকারকে বদলি জনিত বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই সভায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আবদুর রাজ্জাক, জেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা মোজাফফার উদ্দীন ও সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষকদের কাউকে না জানিয়ে হঠাত করেই সভার শেষে ব্যানার দিয়ে দুলাল বাবুকে সংবর্ধনা দেয়ার ঘটনায় তাৎক্ষনিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন কয়েকজন শিক্ষক। বরগুনা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সাধারণ সম্পাদক মীর মোস্তাফিজ লিটন সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, দুলাল বাবুর বামহাতের কিছু দালাল শিক্ষক আমাদের সভায় হঠাত করেই ব্যনার দিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করে। আমরা হচকিত হয়ে পড়েছিলাম। একজন মহা দূর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারিকে সংবর্ধনা! শিক্ষক হিসেবে এটা আমরা মানতে পারিনি। তাই আমাদের অনেকেই তাৎক্ষনিক সভাস্থল ত্যাগ করে সংবর্ধনা বর্জন করি। লিটন বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার, বরগুনা সদর এর ব্যানারে সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল আলীম লিটনের নেতৃত্বে গুটিকয়েক শিক্ষক আমাদের বøাকমেইল করে সংবর্ধনা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
গত বছরের ৩০ জুলাই বরগুনা সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী কাম হিশাব রক্ষক দুলাল কৃষ্ণ মালাকার ওরফে দুলাল বাবুর বিরুদ্ধে ৪৭ জন শিক্ষক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেন। গ্রেডের বকেয়া বিল, চাকরি স্থায়ীকরণ, শ্রান্তি বিনোদন ভাতাসহ নানা ধরণের বিল পাওয়ার জন্য দুলাল বাবু শিক্ষকদের জিম্মি করে ঘুস আদায় করেন আসছেন বলে অভিযোগে দাবি করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, সহকারি শিক্ষকদের ২০২০ সালের ৯ ফেব্রæয়ারি থেকে প্রাপ্য ১৩ তম গ্রেডের বকেয়া বিল দেয়ার জন্য ছয়শতাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে অন্তত ৬ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। ঘুষ বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকার কারনে ২০২১-২২ অর্থ বছরে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের আনুসঙ্গিক খরচের ৩৯ টি চেক নির্ধারিত সময়ের (২৬ জুলাই) মধ্যে অফিসের ব্যাংক হিসেব নম্বরে জমা দিতে পারেননি দুলাল বাবু। যার কারণে ১কোটি ৫৮ লাখ উক্ত টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত চলে যায়। এছাড়াও দীর্ঘ ৩২ বছর একই কর্মস্থলে থাকায় দূর্নীতির আখড়া গড়ে তুলেছিলেন দুলাল বাবু। ঘুস গ্রহনের জন্য তার টালিখাতাও খোলা ছিল মর্মে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগের পরে তদন্ত কমিটির প্রধান তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজনুর রহমান গত ২ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মুহিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা রুজুকরনের সুপারিশ করা হয়। ২৯ আগস্ট দুলাল বাবুকে বরখাস্ত ও ১৪ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সাময়িক বরখাস্তের মেয়াদ শেষ হবার পর ১১ ডিসেম্বর বরগুনা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসে স্বপদে যোগদান করেন দুলাল। যোগদানের তারিখেই বরগুনা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সাধারণ সম্পাদক মীর মোস্তাফিজ লিটন দুলাল বাবুকে কর্মস্থল থেকে বদলী করার দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে দরখাস্ত করেন। এরপর তাকে বরগুনা সদর উপজেলা থেকে আমতলী উপজেলায় বদলি করা হয়।
বরগুনা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সাধারণ সম্পাদক মীর মোস্তাফিজ লিটন বলেন, একজন দুর্ণীতি পরায়ন ব্যক্তিকে সংবর্ধনা দেওয়াটা জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের পরিপন্থি। এতে করে অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা কর্মচারিরা আরো বেশি দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হবে। আমি তার ঘুস দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। এটা শিক্ষক হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ব। আর যারা সংবর্ধনা দিয়েছে তারা অনৈতিক কাজ করেছে এবং আমাদের সুকৌশলে ব্যবহার করতে চেয়েছে।
সংবর্ধনা দেয়া প্রসঙ্গে বরগুনা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল আলীম লিটন বলেন, দুলাল বাবু দির্ঘবছর ধরে আমাদের শিক্ষকদের কাজে সহায়তা করে আসছেন। আমরা তাকে বদলিজনিত সংবর্ধনা দিয়েছি। দূর্নীতির দায়ে শাস্তি হয়েছে মামলা চলছে সেটা ভিন্ন বিষয়।
দুর্নিতীর দায়ে অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়া হলো বিষয়টি জানতে জেলা প্রথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আবদুর রাজ্জাকের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন।
সদর উপজেলা প্রাথমকি শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কল রিসিভ করেননি।