ঢাকাবুধবার, ৭ই জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, রাত ১০:১১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পাত্তাই দিচ্ছে না মহিব!

দৈনিক সৈকত সংবাদ
জানুয়ারি ২৫, ২০২২ ২:৫৩ অপরাহ্ণ
পঠিত: 71 বার
Link Copied!

আবদুর রহমান সালেহ, বরগুনা : শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের সহজাত স্বভাব হচ্ছে অন্যের থেকে সহযোগিতা নেয়া। অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী তেইশ বছর বয়সী তরুণ মহিবের ভাবনা এক্ষেত্রে ভিন্ন। জন্ম থেকে এক হাত নিয়ে বেড়ে ওঠা মহিব অন্যের থেকে সহযোগিতা পেতে নয়, অন্যদেরকে সহযোগিতা করতেই বরং বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শারীরিকভাবে কিছুটা অক্ষম মহিব তাই নিজের জেদের কাছে লড়াই করে হয়ে উঠেছেন অন্যদের কাছে অনন্য উদাহরণ। মহিব কি কি প্রতিবন্ধকতা জয় করে বেড়ে উঠেছে? শুনবো সেই গল্পগুলোই।

কটূক্তি যখন প্রেরণা:
শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষেরা প্রতিনিয়তই কটূক্তির শিকার হয়। মহিবের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। মহিবের ভাষায়- ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটাই তো বড় ধরণের কটূক্তি। আমাদের সমাজে এটিকে প্রায় গালির পর্যায়ে ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানোকে খুব একটা ইতিবাচকভাবে দেখা হয় না। আমি অবশ্য সব ধরণের নেতিবাচক মানুষদের এড়িয়ে চলি। শুধু এড়িয়েই চলি না, তাদের হাসির ছলে বলা কথাগুলোকে জেদ হিসেবে নিয়ে বাস্তবে তার প্রমাণও দিয়ে দেই। এটাকেই আমি সদুত্তর হিসেবে উপযুক্ত মনে করি।

বাইকার হয়ে ওঠার গল্প :
হেয়ালির ছলে কেউ একজন মহিবকে বলেছিল, তুমি বাইক চালাতে পারবে না। তোমাকে দিয়ে এটা সম্ভব না। কথাটি সরাসরি মহিবের কান পর্যন্ত পৌঁছেই থেমে থাকেনি, অদম্য উদ্দীপনায় নিজের মনকে যেন নিজেই জানান দিচ্ছিল- যে কোনোভাবেই হোক বাইক চালানোটা শিখতে হবে এবং অবশ্যই পেশাদার বাইকারদের মত করেই শিখতে হবে। একটু একটু করে জমানো নিজের উপার্জনের অর্থ দিয়ে বাইক কিনে অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে সবাইকে চমকে দিয়ে দিব্যি মটরবাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মহিব। অবশেষে হেয়ালির ছলে বলা সেই ভদ্রলোককেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মহিব- একসাথে বাইক রাইড করার! মহিবের এমন আমন্ত্রণ নিশ্চয়ই সেই ভদ্রলোকের ভাবনাকে অনেকটাই বিব্রত করেছিল। কিংবা এমনও হতে পারে ভদ্রলোকও মহিবের আত্মপ্রত্যয়ী পারফরমেন্সে অবিভূত হয়ে গিয়েছিল কিনা। ব্যাপারটি অবিভূত হওয়ার মতই।

প্রতিবন্ধী বন্ধুদের পাশে আস্থার উপস্থিতি:
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বহুমাত্রিক শারীরিক অক্ষমতায় জর্জরিত ডলির পরিবারের জায়গা উচ্ছেদ করতে চায় স্থানীয় একদল দুর্বৃত্ত। বিষয়টি ডলি তার বন্ধু মহিবকে জানাতেই ডলিকে সমস্যামুক্ত করতে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে আনাগোনা শুরু করে মহিব। অবশেষে বরিশালের বর্তমান জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দারের সহযোগিতায় ডলিকে।

বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হয় মহিব। ডলির পরিবার এখন তাদের বসবাসের স্থানে নিরাপদ জীবন যাপন করছে, যার নেপথ্যে পুরো ভূমিকা ছিল মহিবের। শুধু ডলির পরিবারের পাশেই নয়, মহিবের মত যারা বিভিন্নভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষজন রয়েছে মহিব স্বেচ্ছায় তাদের খোঁজ নেয়, প্রয়োজন পূরণ করে। আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সমস্যায় জর্জরিত সহপাঠীদের মুখে হাসি ফোটানোর প্রত্যয় নিয়ে। পরীক্ষার ফরম পূরণ থেকে শুরু করে স্বল্প পরিসরে চাকরি কিংবা কাজ পাইয়ে দেয়ার নিরন্তর চেষ্টায় আন্তরিকতার ঘাটতি থাকে না মহিবের। এভাবে করে অনেকের মুখেই হাসি ফোটাতে ইতোমধ্যে সক্ষম হয়েছে সে।

 

রক্তদাতাই শুধু নয়, সংগ্রহ করেন রক্তদাতাদেরও:
জরুরী প্রয়োজনে শুভাকাক্সক্ষীসহ বিভিন্ন মানুষদেরকে নিয়মিত রক্ত দেয়াই শুধু নয়, ব্যবস্থা করছেন অগণিত রক্তদাতাদেরও। মহিবের সান্নিধ্যে থাকা মানুষজন জরুরী রক্তের প্রয়োজন হলে একপ্রকার নিশ্চিতভাবেই মহিবকে স্মরণ করে। কারণ এতদিনে তারা জেনে গেছে- মহিবকে স্মরণ করলে জরুরী মুহূর্তে রক্ত তারা পাবেই। যেভাবেই হোক মহিব তা ব্যবস্থা করবে। মহিবের গÐির মধ্যে থাকা মানুষদের কাছে এভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করেছে ইতোমধ্যে।

মহিবের আরও যত গুণ:
পেশাদার বাইকিং থেকে শুরু করে এসি-ফ্রিজ মেরামত, ইলেকট্রনিক্স এর কাজেও রয়েছে দক্ষতার সরব উপস্থিতি। কম্পিউটার কম্পোজ থেকে শুরু ইন্টারনেটের ভুবনেও দারুণ পদচারণা তার। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলায়ও সহযাত্রীদের থেকে কম যায় না মহিব। মহিবের ভাষায়- আমি যখন যা করি তা সর্বোচ্চ মনোযোগের সাথেই করি। শারীরিকভাবে অক্ষম শ্রেণির আওতায় থাকি বলে কটু কথা তো অনেকেই বলে, এই কটু কথা থেকেই মূলত জেদটা বেশি কাজ করে। তাই মনের অজান্তেই হয়তো জোরালোভাবেই সবগুলো বিষয়ের ওপর জোর দিতে হয়। আর এই জোরালো চেষ্টাই হয়তো কিছু কিছু বিষয়ে ভালো পারফর্ম করার মূল উপকরণ।

জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা :
আমতলী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের হাসপাতাল রোড সংলগ্ন এলাকায় ৩ মার্চ, ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করা মহিবের বাবা ওমর আলী শিকদার, মা আফরোজ বেগম।

তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট মহিব। বড় বোন ফাতেমা আক্তার মুকুল বরগুনার আমতলী বন্দর মডেল হোসাইনিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বাংলা বিভাগের প্রভাষক, ছোট বোন গৃহিণী।

মহিবের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বরগুনার আমতলী উপজেলার ছুরিকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর আমতলী একে পাইলট হাই স্কুল থেকে ২০১৪ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি, এবং ২০১৮ সালে পটুয়াখালী সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিউট থেকে রেফ্রিজারেশন এন্ড এয়ার কন্ডিশনিং বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে বর্তমানে বরিশালের প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব গেøাবাল ভিলেজ-এ ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিএসসি তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।

অর্জন :
শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আইসিটি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত আইটি টেস্ট প্রতিযোগিতায় বরিশাল বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা মেধাবীর পুরস্কার হিসেবে ল্যাপটপ অর্জন থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ ক্রীড়াঙ্গণেও আলো ছড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে সম্মাননা, ক্রেস্ট অর্জনের ধারাবাহিকতায় বরাবরই এগিয়ে থাকে মহিব। আবৃত্তির ভুবনেও রয়েছে নীরব পদচারণা। আবৃত্তি পাঠে অডিয়েন্সকে মুগ্ধ করে দেখা মিলেছে একটু আধটু পুরস্কারেরও।

ভবিষ্যত গন্তব্য
ভালো চাকরি পেয়ে মা, বোন এবং পরিবারের সকল সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানোটাই মহিবের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। পাশাপাশি মহিবের উপর আস্থাশীল মানুষদের মুখের হাসিও অটুট রাখতে বদ্ধ পরিকর মহিব।

সব বাধা পেরিয়ে জীবনের পথে ক্রমশও এগুতে থাকা মহিব নিকট ভবিষ্যতে শুধু পরিবারের মুখেই নয়, হাসি ফোটাবে আরও অগণিত মানুষদের মুখেও। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে যে তরুণ পাত্তা দেয় না মোটেই, এগিয়ে যেতে চূড়ান্ত লক্ষ্যে। সেই মহিব তার চূড়ান্ত গন্তব্যে দেরিতে হলেও পৌঁছাবে। এমন আশাবাদী হতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না, এটা মহিবের আত্মবিশ^াস এবং আত্মবিশ^াসের সাথে বাস্তবভিত্তিক কর্মকাÐের মাধ্যমে সহজেই প্রতীয়মান হয়। নিকট ভবিষ্যতের গন্তব্যেও মহিব আলো ছড়াবে, এমন প্রত্যাশা অগণিত মানুষদের। ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকা মহিব সবার প্রত্যাশা পূরণের বাতিঘর হয়ে উঠবে, এমন দিনের অপেক্ষা করাই যায়।

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।