বরগুনার তালতলী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক। জনগণের সেবা করেও নিয়মিত শয্যাশায়ী অসুস্থ্য মায়ের সেবাযত্ন করে মাতৃভক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।
উপজেলার কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা মো.ফকর উদ্দিন মিয়া (৯৫) ও মোসা.সালেহা বেগম (৭৫)
দম্পত্তির ছোট ছেলে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক।
মোস্তাকের মা সালেহা বেগম প্রায় ৭ বছর ধরে শয্যাশায়ী। ব্রেইন স্ট্রোক করে শরীরের অবশ হয়ে গেছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মাকে অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। দেশের নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। শয্যাশায়ী মাকে ধরে ধরে বিছানা থেকে ওঠাতে হয়। বিছানায়ই তিনি মলমূত্র ত্যাগ করেন। কথা বলতে পারেন না, কথা আটকে যায়। চোখে তার কেবলই কান্না। মাকে বিছানা থেকে তোলা, ধোয়া-মোছা, গোসল করানো, খাবার খাওয়ানো, কাপড়-চোপড় কাচা, রান্না-বান্না, সবকিছু করতে হয়। গত সাত বছর ধরে প্রতিটি দিন এভাবেই অসুস্থ্য মায়ের সেবাযত্ন করে কাটিয়ে চলেছেন মোস্তাক। ৩৪পেরিয়ে গেলেও বিয়ে করেননি তিনি। মাকে নিয়েই তাঁর সংসার।
সেজ ভাই রিয়াজুল ইসলাম বলেন, জন্মের সময় মা আমাদের খাইয়ে দিয়েছে গোসল করিয়াছে অসুস্থ হলে সারারাত সজাগ থেকেছেন ভাইস চেয়ারম্যান ও তাই করছে মায়ের ৮০% সেবাযত্ন সব ও করে।
সরেজমিনে ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় মাকে গোসল করিয়ে কাপর চোপর ধুইয়ে খাবার খাইয়ে সালিশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন মোস্তাক।
মায়ের সেবাযত্ন করে জনগণকে সময় দেন কখন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাক বলেন, মাতৃসেবা আমার বহুদিনের সাধনা। আমি বাবা ও মা উভয়ের সেবাযত্ন করে তারপর বাড়ি থেকে বের হই। তারপর জনগণের কাজ সেরে সময় মত আবার এসে তাদের দেখাশোনা করি।
৩৪ পেরিয়ে গেছে এখনো বিয়ে করে সংসার করছেননা কেন? বিয়ে করলে আপনার স্ত্রী তো তাদের খেদমত করতে পারে?
এ প্রশ্নের জবাবে মোস্তাক বলেন, আমি ভাবি বিয়ে করলে মা বাবার এমন সেবা কি করতে পারব? বিয়ে করলে আমার স্ত্রী তাদের খেদমত না করতে পারে সংসারে ঝামেলা হতেপারে। চারপাশে যারা আছে তারা তো পারে না এমন খেদমত করতে। আমার কাছে আমার মা বাবা পরম ধর্ম। এই ধর্মের মধ্য দিয়েই বেহেশতের পথে হাঁটতে চাই।
সেজ ভাই রিয়াজের স্ত্রী খালেদা বেগম বলেন, আমার
শশুর শাশুড়ির সব কাজ দেবর মোস্তাক করে, তার অনুপস্থিতে আমারা করি। সে যখন থাকে তখন গোসল করানো, কাপড় ধোয়া, খাওয়ানো, ডাক্তার দেখানো, চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ানো। দেখলে মনে হয় বাবার কোলে ছোট্ট শিশু। এলাকাবাসী জানায়, মায়ের প্রতি মোস্তাকের শ্রদ্ধার তুলনা হয় না। কোথাও কাজে গেলে বাড়িতে এসে দেখে যাবে সে। মায়ের কষ্টের কথা ভেবে কোথাও বেড়াতে যান না তিনি।
প্রতিবেশী মাওলানা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের আশপাশে এমন দৃষ্টান্ত কোথাও দেখা যায় না। ওর সততা এবং মাতৃভক্তি দেখে আমরা অবাক হই নির্বাচনে কিন্তু ও সময় মত ওর মায়ের সেবাযত্ন করেছে। ওর মায়ের দোয়া ওর সাথে আছে। এমন ব্যক্তির জন্য আমাদের গর্ব হয়। আজকাল এমনটা তো দেখাই যায় না।
তালতলী মদিনা মসজিদের ইমাম মুফতি ইসমাইল হোসেন বলেন,সন্তান নিজের দুঃখে, সুখে, ভালো বা খারাপ সর্বাবস্থায় যদি পিতামাতার দিকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির নজরে তাকায়, তাহলে সন্তানের আমলনামায় কবুল হজের সওয়াব লিখে দেওয়া হয়। এমনকি সে সন্তান যদি পিতামাতার দিকে ১০০ বারও তাকায়, তার আমলনামায় ১০০ কবুল হজের সওয়াব দেওয়া হবে। ভাইস চেয়ারম্যান যা করছে নিসন্দেহে সওয়াবের কাজ
হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে সন্তান তার পিতামাতার দিকে সশ্রদ্ধ ও ভালোবাসার নজরে তাকায়, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহপাক তার আমলনামায় একটি কবুল হজের সওয়াব লিখে দেন।
এলাকার স্কুলশিক্ষক জিয়াউল হক রুবেল বলেন, বায়েজিদ বোস্তামি আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা বইয়ে পড়েছি। বাস্তবে মোস্তাককে দেখে আরেক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। মোস্তাক তার মায়ের খেদমত করে আজ ভাইস চেয়ারম্যান ও ভবিষ্যতে আরও বড় কিছু হবে। আমার মনে হয় বাংলাদেশে এটা বিরল ঘটনা এটা।
বাবা ফকর উদ্দিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আধো আধো বলেন, মোস্তাককে আমি অনেক বলছি তুই বিয়া কর বাবা। কিন্তু মোস্তাক শোনে না যে সন্তান ওর মায়েরে আমারে কোনো দিন কষ্ট দেয় না। আল্লাহর দরবারে চাওয়া বিশ্বের সব ঘরে মোস্তাকের মতো সন্তান যেন জন্মায়। আমার তো ওরে দেওয়ার কিছু আছে শুধু আল্লাহর দরবারে ওর জন্য দোয়া।