২০২১ সালের পয়লা দিন ছিল সেটা। কে যেন বলে উঠলেন, ‘বছরের প্রথম দিনই আটকাইয়া দিলেন।’ আরেকজন রসিকতার সুরে বললেন, তবু ভালো যে তীরে এসে তরি ডোবেনি, শুধু আটকেছে!
তবে নিঝুম দ্বীপ থেকে হাতিয়া বা অন্য কোনো গন্তব্যে যাঁদের নিত্য যাতায়াত, জোয়ার-ভাটার সময় কষে যাঁদের জীবন, স্থানীয় এমন কয়েকজনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে খোশমেজাজে আছেন তাঁরা। আমাদের মতো পর্যটক ছিলেন জনা পনেরো। যার মধ্যে একই পরিবারের ছয়জন। এই ‘জনগোষ্ঠী’র মধ্যেই কিছুটা উদ্বেগ—কখন আসবে জোয়ার, কখন আসবে জোয়ার!

ততক্ষণে রোদের তীব্রতা বেড়েছে। শীতের পোশাক বোঝা মনে হতে শুরু করেছে। পরিচয় পর্বের পর পর্যটককুলের মধ্যে হৃদ্যতা বেড়েছে। হৃদ্যতার কারণ সবার লক্ষ্য ও গন্তব্য এক।
একজন বাড়ি থেকে পিঠাপুলি সঙ্গে এনেছিলেন। খাতির হওয়া মানুষের মধ্যে বিতরণ করলেন। পিঠাপুলি আর গল্পে গল্পে সময় কাটলেও জোয়ারের খোঁজ নেই। ‘জোয়ার কখন আসবে,’ এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে ক্লান্ত মাঝি মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ সহকারীকে আদেশ দিলেন, ‘ওই ইঞ্জিন চালু কর।’
ট্রলার চলতে শুরু করল। যাত্রীদের অনেকে হইহই করে উঠলেন। মাঝির মুখে প্রথমবারের মতো হাসির দেখা মিলল। সে হাসি থাকল নিঝুম দ্বীপের নামাবাজার ঘাটে ট্রলার নোঙর করার পরও।

কোনো রুম ফাঁকা নেই
চরে যেভাবে ট্রলার ধাক্কা খেয়েছিল, নিঝুম দ্বীপে নেমে তেমনি ধাক্কা খেলাম আমরা। স্থানীয় যে লোকের সঙ্গে আমাদের পূর্বযোগাযোগ, যিনি আমাদের থাকা-খাওয়া নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলেন, তাঁর কপালে দেখি ভাঁজ। অস্ফুটে বললেন, ‘কিছুই তো খালি নাই।’ কথাটা তিনি না বললেও হতো। সামনে দাঁড়িয়েই শুনছিলাম, তিনি যে হোটেলেই খোঁজ করলেন, অপর প্রান্ত থেকে সবার এক কথা—আজ কোনো রুম ফাঁকা নেই!
কারণ খুঁজতে গিয়ে জানলাম, শীতের সময়টায় পর্যটকদের আনাগোনা কিছুটা বেড়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, বিচ্ছিন্ন দ্বীপটিতে সেদিন একজন সচিব এসেছেন সপরিবার। তাঁর সম্মানে নোয়াখালী জেলা ও হাতিয়া উপজেলা থেকে পদস্থ অনেক সরকারি লোক এসেছেন। দ্বীপে মোটামুটি মানের যে আবাসন আছে, সবই তাঁদের কবজায়।
শেষমেশ মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হলো নামাবাজার মসজিদ কর্তৃপক্ষ যে ‘মসজিদ বোর্ডিং’ নির্মাণ করেছে, সেখানকার একটি কক্ষে।

হরিণের সন্ধানে
কেওড়া বন, হরিণ আর নিঝুম দ্বীপ—যেন সমার্থক। অন্তত ভ্রমণে আসার আগে তাই মনে হয়েছে। কারণ, নিঝুম দ্বীপের অধিকাংশ ছবিতে কেওড়া বনে অজস্র হরিণ চরে বেড়াতে দেখা যায়। বোর্ডিংয়ে ব্যাগ রেখে সেই হরিণের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। বাজার থেকে একটা মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে ছুটে যাই নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের পথে। কিন্তু বনের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরেও কোনো হরিণের সন্ধান মিলল না। হরিণ বাদ দিয়ে তাই প্রকৃতির দিকে মনোযোগী হই। দ্বীপের নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে নদী, নদীপাড়ের জীবন আর বিস্তৃত যে সবুজ মাঠের সন্ধান মিলল, তা-ই বা হৃদয় প্রশান্ত করার জন্য কম কিসে।

প্রকৃতির মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসি নামাবাজার সমুদ্রসৈকতে। সূর্য ততক্ষণে বিদায় নেওয়ার তোড়জাড় করছে। ওদিকে বালিয়াড়িতে একদল পর্যটক তাঁবুবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁদের পাশেই দাঁড়াই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি বিদায়ী সূর্যের দিকে। হলুদ সূর্য ক্রমে রক্তিম হয়ে ওঠে। লাল টকটকে সূর্য মিলিয়ে যায় দূর সাগরে।
জেনে নিন
ঢাকার সদরঘাট থেকে নোয়াখালীর হাতিয়াগামী লঞ্চ প্রতিদিন চলাচল করে। যাত্রা শুরুর সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা। এই লঞ্চগুলো হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে নামিয়ে দেবে সকালে।

তমরুদ্দি ঘাটে নেমে সরাসরি ট্রলারে নিঝুম দ্বীপের নামাবাজারে যেতে পারেন। ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। ট্রলার রিজার্ভ নিতে পারেন। একা কিংবা দু-তিনজনের দল হলে ভিড়ে যেতে পারেন অন্যদের সঙ্গে। জনপ্রতি ট্রলারভাড়া নেবে ২০০-২৫০ টাকা।
আরেকটি পথও আছে। তমরুদ্দি ঘাট থেকে অটোরিকশা বা মোটরবাইকে চেপে দেড় ঘণ্টায় চলে যান মোল্লার ঘাট। সেখান থেকে ট্রলারে বন্দরটিলা পাঁচ মিনিটের পথ। এরপর ১৫ বা ২০ মিনিটে নামাবাজার।
নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য জেলা পরিষদের ডাকবাংলো আছে। আছে বন বিভাগের বিশ্রামাগার, আর ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু আবাসন ব্যবস্থা। বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁবুবাসের ব্যবস্থাও আছে। যাত্রার আগে আবাসনের ব্যবস্থা করে গেলে আমাদের মতো ভোগান্তি পোহাতে হবে না!