সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য শাখানদী ও খালের মধ্যে অন্যতম বরগুনার ভারানী খাল। খাকদোন নদের এ শাখা খালটি বরগুনা পৌরসভার মাছবাজার এলাকা মাদরাসা সড়ক হয়ে বুড়িরচর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে দক্ষিণে সাত কিলোমিটার গিয়ে পায়রা নদে যুক্ত হয়েছে।
জেলা শহরের সাথে নৌপথ কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যের নির্ভরযোগ্য চলাচলের মাধ্যম ছিল খালটি। কিন্তু দখলদারদের দৌরাত্ম্য, পলি জমে ও দূষণে সময়ের ব্যবধানে এটি মরা খালে পরিণত হয়। একই সঙ্গে খালের আরও সাতটি শাখা খালেরও একই অবস্থা হয়।
অবশেষে ভারানী খাল দখলমুক্ত ও পুনঃখননের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। দুদিকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর খননকাজও এখন শেষের পথে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে স্থানীয় পরিবেশবাদী ও সচেতনমহল খালটি দখলমুক্ত করতে আন্দোলন শুরু করেন। ওই বছরের ২৮ মার্চ ও ১০ এপ্রিল দুই দফায় বরগুনার খাকদোন নদ ও ভারানী খাল অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করে পানি প্রবাহ নিশ্চিতের দাবিতে মানববন্ধনও হয়েছে।
এতে বরগুনা প্রেস ক্লাব, বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি, বরগুনার পরিবেশ আন্দোলন কমিটি, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের বরগুনা শাখা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এনজিওকর্মীসহ নানা শ্রেণিপেশার সহস্রাধিক স্থানীয় অধিবাসী অংশগ্রহণ করেন। এতে তৎপর হয় জেলা প্রশাসন। এরপর বরগুনা জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহায়তায় পৌরসভা অংশের দেড় কিলোমিটার এলাকার উভয় পাড়ে ১৩৫ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি করে। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জন্য উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা সে সময় সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর খাল উদ্ধারে আইনি সহায়তা চেয়ে একটি আবেদন করে। একই মাসে খালটির দখল উচ্ছেদ ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে বেলা উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করে। প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিব আল জলিল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বরগুনা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) খালটি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বরগুনা জেলা প্রশাসন ভূমি অফিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে ডিসেম্বরে শেষ হয়। এরপর বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড খালটি পুনঃখননের প্রকল্প হাতে নেয়।
পাউবো কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভারানী খালের খনন কাজ শুরু হয়। চট্টগ্রাম জেলার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স গরীবে নেওয়াজ ও পটুয়াখালী জেলার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আল মামুন এন্টারপ্রাইজ যৌথভাবে এ খাল খননের প্রকল্পটির কার্যাদেশ পায়। এদের কাছ থেকে খাল কাটার দায়িত্ব নেন বরগুনা জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ হুমায়ূন কবির। তার তত্ত্বাবধায়নে টেন্ডারের মাপ অনুসারে খাল কাটা হয়েছে বলে জানান স্থানীওরা। খাল কাটার পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ স্থানভেদে ২৬ থেকে ৩০ মিটার বা ৮৫ থেকে ১০০ ফুট ও নিম্ন স্তরের প্রস্থ ১২ মিটার বা ৩৯.৩৬ ফুট এবং বর্তমান অবস্থান থেকে গভীরতা ২.৫ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত বা ৬.৫০ ফুট থেকে ৯ ফুট। গতবছরের আগস্ট মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খননকাজ শুরু করে। বৃষ্টি ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় খননকাজ বন্ধ থাকলেও শীত মৌসুমের শুরু থেকে পুরোদমে ফের খনন শুরু হয়। বর্তমানে খালটির খনন প্রায় শেষ পর্যায়ে।খননের ফলে খালটিতে অবাধে জোয়ারভাটার প্রবাহ থাকবে এবং ফের নৌযান চলাচলের উপযোগী হবে মনে করছেন স্থানীয়রা।
বরগুনা জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ হুমায়ূন কবির বলেন, ভাড়ানি খালের অবৈধ দখলদারিত্ব স্থায়ী ভাবে বন্ধ করতে হলে দুই পাড়ে সিসি বøক বসাতে হবে।
বরগুনা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করেছি, খাল দখলমুক্ত হয়েছে এবং খননের কাজও প্রায় শেষ। এই খালটির উভয়পাড়ে এখন সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করলে চমৎকার একটি জায়গায় পরিণত হবে।’
বরগুনা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাফিজ বলেন, ‘আমরা এই খাল দখলমুক্ত করতে আন্দোলন করেছিলাম। সেটি এখন দখলমুক্ত ও প্রশস্ত একটি খালে পরিণত হতে চলেছে। সত্যি এটি আমাদের জন্য যেমন উপকারী হবে তেমনি পরিবেশও ফিরে আসবে।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘খালটি দখলমুক্ত করতে আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের খননকাজ শেষ হলে এটিকে ঘিরে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা যায় কি না, তা নিয়ে পৌর মেয়রের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসবো।