জন্ম থেকেই দু’টি পা নেই তাঁর। তবুও তিনি হাঁটছেন জীবনের পথে। শত বাঁধা পেরিয়ে তিনি এগিয়েই চলেছেন বিজয়ীর বেশে। বলছি বরগুনার এক অদম্য নারী অমৃতা বালার জীবনের গল্প। চোখে আঙ্গুল দিয়ে যিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছে শক্তিই বড় শক্তি।
অভাব অনটন আর নিদারুণ দারিদ্রের মাঝে জন্ম তাঁর। জন্মের পরপরই নিরুদ্দেশ বাবা। কোথায় আছেন কেমন আছেন জানা নেই কারো। দেনার দায়ে বন্ধক রাখতে হয়েছে পৈত্রিক ভিটেটুকুও। অবজ্ঞা অবহেলা আর শত বঞ্চনার মাঝেই তাঁর বেড়ে ওঠা।
তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। হামাগুড়ি দিয়েই এগিয়ে চলেছে তাঁর শিক্ষা জীবন। কৈশোরে দুমাইল দূরের গ্রাম থেকে নিয়মিত স্কুলে আসতেন তিনি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে এখন তিনি স্নাতক। চলছে স্নাতকোত্তর লেখাপাড়া। চলছে জীবন সংসারও।
বরগুনার পুরাকাটা গ্রামের গণেশ বালা ও বিভা রাণীর মেজ সন্তান অমৃৃতা বালা (২৮)। জন্মের পর প্রতিবন্ধি সন্তানের মুখ দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় বাবা। পরম যতনে আঁচলে আগলে রাখেন দু:খিনী মা। বড় আদর করে মেয়ের নাম রাখেন অমৃতা বালা। নামে অমৃতা বালা হলেও বড় তিক্ততায় ভরা জীবন তাঁর। ইচ্ছে থাকা সত্তেও অংশ নিতে পারেননি শৈশব কৈশরের কোন খেলাধুলায়। আম কুড়ানোর স্মৃতি নেই তার জীবনে। খুব একটা মেলেনি বন্ধু-বান্ধবও। অবজ্ঞা অবেহলাই যেন তাঁর নিত্য সঙ্গী।
জীবিকার তাগিদে ভাই অশীষ বালা সংসার পেতেছেন বন্দর নগরী চট্টগ্রামে, টানা পোড়েনের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরোয় তাঁর। ছোট বোন মালোশি কর্মকরের বিয়ে হলেও বিয়ের পিরিতে বসা হয়নি অমৃতার।
অমৃতার মা বিভা রাণী বলেন, ‘অমৃতার বাপে (বাবা) কুম্মে থাহে হ্যা মোরা জানি না, দুই বুইনেরে ল্যাদা থুইয়া কুম্মে যে গ্যাছে আর কোন খোজ খবর নাই, তয় আট বছর আগে ছোট মাইয়ার বিয়ার কালে একফির আইছেলে পরে আবার চইল্লা গ্যাছে। ‘এই মাইয়ারে লইয়া আমি অনেক কষ্ট করছি জীবনে, মাইনষের বাসায় কাম হইর্যা, বদলা দিয়া, মাডি কাইট্টা, অনেক কষ্টে মানুষ করছি মাইয়াডারে। কত যে না খাইয়া দিন কাডাইছি আমরা’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে হামাগুড়ি দিয়ে নিজেই ক্লাসে গেলেও বৃষ্টির মৌসুমে কখনোই ক্লাস করতে পারেনি অমৃতা। উচ্চ-মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যলয় বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় যেতে হতো রিক্সা বা ভ্যানে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে সবসময় যাতায়াত ভাড়া না থাকায় নিয়মিত ক্লাসেও যেতে পারতো না অমৃতা। মেয়ের ইচ্ছা সরকারী চাকরি করার, তাই সরকারের প্রতি তার আকুল আবেদন যেন তার মেয়েকে একটি সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
খোজ নিয়ে জানা যায়, পৈত্রিক সম্পত্তির মধ্যে বসবাসের জন্য ছোট্ট একটি যৌথ মালিকানার জীর্ণ শীর্ণ ভাঙা ঘর আর ২০ শতাংশ জমি (বর্তমানে বন্ধক রয়েছে) ছাড়া আর কিছুই নেই । আসবাবপত্রের মধ্যে একটা পড়ার টেবিল, দুটি চেয়ার, একটা মাটির গোলা আর দুটো পুরোনো চৌকি। এর মধ্যেই চলছে দুটি প্রানের নিরব বসবাস। অতি অল্প বয়সে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সংসারের হাল ধরেছেন অমৃতা। এত অভাব অনটন আর টানা পোড়নের মাঝেও বিধাতা কিংবা ভাগ্যকে দোষারোপ করে থেমে থাকেননি তিনি। পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন নিজ প্রচেষ্টায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহোযোগিতায় নিয়েছেন কম্পিউটার প্রশিক্ষন। পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনি করে দু বেলা অন্য জোগাড় হয় তাদের। গাড়ি ভাড়া আর টিউশনির টাকা জমিয়ে এগারো হাজার টাকায় কেনেন একটি দুধের গাভী। সেখান থেকেই চরটি গরুর ছোট্ট একটি খামার। এভাবেই এগিয়ে চলেছে অমৃতার সংগ্রামী জীবন।
অমৃতা বলেন, আমি আমার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাই এবং সমাজের বোঝা হয়ে বাঁচতে চাইনা। সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্নাতোকত্তর শেষ করবো এবং পাশাপাশি সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী যদি চাকুরী পাই করব।
অমৃতার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ শামছুল আলম বলেন, আমার শিক্ষকতা জীবনে অমৃতার মত পরিশ্রমি আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির মানুষ দ্বীতিয়টি দেখিনি। ও (অমৃতা) দুই হাটুতে ভড় করে হামাগুড়ি দিয়ে দু’মাইল পথ অতিক্রম করে স্কুলে এসে ক্লাশ করতো, পরে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রী পাশ করেছে, আমরা যথা সম্ভব তাকে সহায়তা করেছি।
তিনি আরো বলেন, অমৃতা বড় হয়েছে, সংসারের প্রতি দায়িত্বও বেড়েছে। তাই সরকারের কাছে আমাদের এই একটাই দাবী অমৃতাকে যেন একটি সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এছাড়াও অমৃতার প্রতিবেশি এলাকাবাসি সকলেই একই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।